..............

ঠাকুরমহাশয়ের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো, "যান, মাকে নিয়ে আসেন গিয়া।"

-ঃদাম্পত্য-কলহঃ-

জয় রাম। জয় গোবিন্দ।।

কয়েকদিন ধরে ঠাকুরমহাশয় কলকাতাতেই আছেন।তিরিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। ভোরবেলায় চার-পাঁচ জন আশ্রিত ঠাকুরমহাশয়ের কাছে বসেছিলেন। তাঁহার মুখে অনুপম কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দবোধ করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে গৃহস্বামীর আহবানে তারা অন্দরে গেলেন প্রসাদ গ্রহণের জন্য।প্রসাদ গ্রহণের পর সকলেই ফিরে এসে ঠাকুরমহাশয়ের নিকটে বসলেন। জনৈক ভদ্রলোকের দিকে ঠাকুরমহাশয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, আপনি অফিস যাবেন না, আজ কী ছুটি? উত্তরে তিনি জানালেন, আজ অফিস ছুটি নয়, তবে তিনি আজ যাবেন না স্থির করেছেন। "কেন তিনি কর্মস্থানে যাবেন না? অফিস কামাই করার প্রয়োজন কী?" প্রশ্ন করলেন ঠাকুরমহাশয়। আমতা আমতা করে ভদ্রলোক বললেন, প্রয়োজন কিছুই নেই তবে আজ সারাদিন ঠাকুরমহাশয়ের সান্নিধ্যে থাকেন ইহাই তার ইচ্ছা।
প্রতিদিনের কর্মে কোন গাফিলতি করা ঠাকুরমহাশয় অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। সেইজন্যই ভদ্রলোককে তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান ত্যাগ করে যেতে বললেন। স্নানাহার সেরে অফিসের পর তিনি আসতে পারেন। মাস-মাহিনায় যেখানে তিনি চাকুরী করেন সেখানে বিনা প্রয়োজনে অনুপস্থিত হবেন কেন? কম কাজ করে পুরা মাহিনা নেবেন এ কেমন যুক্তি? ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস অন্যায়েরই সামিল।
প্রচণ্ড দাম্পত্য কলহে গত রাত্রিটি কেটেছে ভদ্রলোকের।  তার সহধর্মিণী সাতসকালেই পুত্র, কন্যাদের নিয়ে আপন পিত্রালয়ে চলে গেলেন। বাধ্য হয়েই ভদ্রলোক সটান এসে উপস্থিত হলেন ঠাকুরমহাশয়ের সামনে।  ঠাকুরমহাশয়কে সূত্র করেই এ বাড়ির গৃহস্বামীর সঙ্গে তার পরম আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। সেজন্য এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অসঙ্কোচে জানিয়েছিলেন যে স্নানাহার তিনি এখানেই করবেন। গৃহস্বামী সানন্দে তাকে সম্মতি জানিয়েছিলেন। দাম্পত্য কলহে পরাজিত হয়ে পলায়নীবৃত্তি আশ্রয় করে ভদ্রলোক ঠাকুরমহাশয়ের কাছে এসেছেন, একথাটা এতক্ষণ তিনি সংগোপনেই রেখেছিলেন। সর্বসমক্ষে পারিবারিক প্রসঙ্গ করা অসমীচীন।
ঠাকুরমহাশয়ের কন্ঠে একটা বজ্র লুক্কায়িত থাকত;  সতত সুধা-ঢালা তাঁহার কন্ঠস্বরের সঙ্গে বিরাট প্রভেদ ছিল সেই বজ্র-কন্ঠের। "আপনে গেলেন না, এখনও বইস্যা আছেন? অফিসে যাওয়ার কী সময় হয় নাই?" ঠাকুরমহাশয়ের বজ্রকন্ঠের কথা কয়টি যেন কানে এসে বাজল। তড়িৎ-স্পৃষ্টের মত উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। অনন্যোপায় হয়ে, এতক্ষণ যা গোপন রেখেছিলেন, তা বলে ফেললেন। তিনি জানালেন, তার স্ত্রী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে সেদিন সকালে তারা শ্বশুরালয়ে চলে গেছে।দরজায় তালা দিয়ে তিনি এখানে এসেছেন। "মায়ের, বাপের বাড়ি যাওয়ার কারণ কী?" জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুরমহাশয়। আর ঢেকে রাখবেন কী করে? কারণ যে দাম্পত্য-কলহ, তা ভদ্রলোক খুলে জানালেন ঠাকুরমহাশয়কে।
সব শুনে ঠাকুরমহাশয় কিছুটা চুপ করে রইলেন।  উপস্থিত ভদ্রলোকেরা মাথা নিচু করে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। ঠাকুরমহাশয় ভদ্রলোককে বললেন, তৎক্ষণাৎ তিনি যেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসেন। বাপের বাড়িতে যদি কোন কাজ থাকে তাহলে তার স্ত্রী নিশ্চয়ই কয়দিন সেখানে কাটাবেন।  কিন্তু এভাবে তাকে একলা ফেলে চলে গেলে তারই বা চলবে কী করে? বিবাহিতা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্ব স্বামীর। কোন অজুহাতেই সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া অন্যায়। যেমন অন্যায় স্বামীর সামান্য দোষে তাকে ছেড়ে স্ত্রীর অন্যত্র থাকা।
ভদ্রলোকের তক্ষুনি শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বিপজ্জনক। সকালবেলা তার স্ত্রী ক্রোধবশেই সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন। সেখানে নিশ্চয়ই গতরাত্রের সব কথা নিয়ে অনেক ঘেঁটি পাকান হয়েছে। এই অবস্থায় ঘন্টা দু' এক পরে তিনি গিয়ে যদি উপস্থিত হন তাতে কোপবর্তীর কোপ বাড়বে বই কমবে না। আশঙ্কার আরও একটি কারণ আছে। তার সহধর্মিণীর দুই সহোদর অত্যন্ত দুর্মুখ। তার পরিচয় তিনি ইতিপূর্বে পেয়েছেন। সহোদরার কাছে সব শুনে তারা যে নীরবে সব সহ্য করবেন এমন তো তিনি কখনই আশা করতে পারেন না। তিনি আঁচ করছেন, তারা যা বলবেন তাতে দুর্বাসার ভাষাকেও বলবে যে দূরে থাক।
আবার ঠাকুরমহাশয়ের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো,  "যান, মাকে নিয়ে আসেন গিয়া।" শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মত মুখ তার নেই সত্য, কিন্তু ঠাকুরমহাশয়ের সঘন তাগিদ উপেক্ষা করতেও তিনি অশক্ত। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রলোক চলে যেতে বাধ্য হলেন।
কলহ-ক্লান্ত দম্পতি অপরাহ্নে ফিরে এসে ঠাকুরমহাশয়ের চরণে পড়লেন। উপস্থিত নরনারীর সঙ্গে ঠাকুরমহাশয় যে কথা বলছিলেন তাতে সহসা ছেদ পড়ল। একবার স্বামীর দিকে, তার পরক্ষণেই স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি রেখে ঠাকুরমহাশয় বলছিলেন--অগ্নিসাক্ষী করে তারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। একে অপরের সুখ-দুঃখ প্রাণ দিয়ে শুধু অনুভবই করবেন না, সেইমত কাজ করার জন্য সতত সচেষ্ট থাকবেন। মতপার্থক্য, সে আছে থাকবেও কিন্তু মনোমালিন্য যেন কখনও না ঘটে। সেজন্য সংসারে থাকতে হলে উভয়ের সর্বদা সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। একজনের মাথা যখন গরম হয়, অন্যজন সচেষ্ট থাকবেন শান্ত থাকতে। উত্তপ্ত শির শীতল হলে তখন তিনি তার বক্তব্য বলবেন। দু'জনে একসঙ্গে উত্তপ্ত হলে সে তো প্রায় দক্ষ-যজ্ঞকে টেনে আনা হবে।
ঠাকুরমহাশয় আরও বললেন, "মা,আপনি রাগ করলে ওর হবে খাওয়া বন্ধ, অফিস কামাই করতেও উনি বাধ্য হবেন।"  স্বামীকে বললেন, "আপনি রাগারাগি করলে মাও বাধ্য হয়েই বাপের বাড়ি যাবেন। এই টানাপোড়েনে আপনাদেরই প্রিয় পুত্র-কন্যা অব্যক্ত বেদনা বোধ করে। সুতরাং আপনারা দু'জনে দু'জনকে দেখবেন। রোষ করে দোষ বাড়াবেন না। মিলে-মিশে সংসার সুখের করার চেষ্টা করবেন।"
দম্পতির দু'নয়ন বেয়ে জলধারা বইছে ঠাকুরমহাশয়ের কন্ঠস্বরের আকুলতায়। একটু থেমে ঠাকুরমহাশয় তাদের বললেন, ভাল করে বাজার করে যেন তারা বাড়ি ফেরেন। পত্নীকে বললেন, মন স্থির করে, পরিপাটি রন্ধন করে স্বামী, সন্তানদের খাওয়াতে এবং নিজেকে খেতে।চোখের জল মুছে ঐ দম্পতি উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময় ঠাকুরমহাশয়ের এক আশ্রিত বলে উঠলেন,  "ঠাকুরমহাশয়, আমাদের জন্য অনেক কষ্ট আপনাকে সহ্য করতে দেখলাম। শেষে আমাদের দাম্পত্য-কলহ মেটাবার জন্য আপনাকেও নেমে আসতে হচ্ছে। আমরা এমনি পাষণ্ড, পামর, যে শালগ্রাম শিলা দিয়ে বাটনা বাটাতে এতটুকু ইতস্ততঃ করছি না। "
জয় রাম। জয় গোবিন্দ।।
ঠাকুরমহাশয়ের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো, "যান, মাকে নিয়ে আসেন গিয়া।" ঠাকুরমহাশয়ের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো,  "যান, মাকে নিয়ে আসেন গিয়া।" Reviewed by SRISRI RAMTHAKUR KOTHA O BANI YOUTUBE CHANNEL on 19:58 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.