ঠাকুর শ্রী শ্রী রামঠাকুরের অনন্য করুণা: নর-নারায়ণের মিলন
জয়রাম জয়রাম। শ্রী শ্রী রামঠাকুর — নরনারায়ণের মিশ্রণ, যিনি মানবতার পথ প্রদর্শন করেছেন। আজ আমরা শোনাবো তাঁর এক অভূতপূর্ব করুণার কাহিনি, যা দেখায় কীভাবে তিনি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখেছেন এবং তাঁদের সেবা করেছেন। কেমন করে এক অসহায় বৃদ্ধাকে শুশ্রূষা করেছেন এবং সামান্য অর্থ দিয়ে বিপন্ন মানুষদের হৃদয় ভরিয়েছেন। আসুন, ঠাকুরের মহান দৃষ্টান্ত থেকে মানবতার গভীর শিক্ষা গ্রহণ করি।"
জয়রাম জয়রাম*
"এমন ই অক্ষম আমি ,দু'দিন ধরে ভিক্ষে- সিক্ষে করে পান- ওয়ালার কাছ থেকে ধার নেয়া পাঁচটাকা পরিশোধ করতে পেরেছিলাম"। (ঠাকুর বলেছিলেন , মনোরঞ্জন গুপ্ত মহাশয়কে)। পূর্ণব্রহ্ম সত্যনারায়ণ তিনি নরের মাঝে এসেছেন শ্রীদেহে। নরের উদ্ধারে নারায়ণ মিলে মিশে একাত্ম হয়ে শিখিয়ে গেলেন অবিরাম, ' অহম আর অহংকার বর্জন করাই মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।'
শ্রীশ্রীঠাকুর আছেন কালীঘাটে এক ভক্তের বাড়ীতে। স্বর্গীয় মনোরঞ্জন গুপ্ত এসেছেন সেই বাড়ীতে। প্রণাম করলেন ঠাকুরকে। ঠাকুর বললেন," আপনি আইছেন, খুব ভালো হইছে। আমারে একটু মোহিনী মোহন শাস্ত্রী মহাশয়ের বাড়ীতে নিয়া চলেন" । মনোরঞ্জন অপারগ বলে দিলেন, কারন তাঁর বিশ্বাস, ' ঠাকুর মশাই শুধু বড়োলোকের বাড়ীতেই যেতে চান'। প্রণাম করে বেড়িয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছে ,ঠাকুরের ইচ্ছার কথা বলে এসেছিলেন। শুনেই শাস্ত্রী মহাশয় খানিক ভর্ৎসনা করে নিজেই ছুটে গিয়েছিলেন সেই ভক্তের বাড়ীতে। নিয়ে এলেন শ্রীশ্রী ঠাকুরকে। ঠাকুর নাম দিলেন শাস্ত্রী মহাশয়ের স্ত্রী আর কন্যাকে। নামের গুণগান ব্যাখ্যা করছিলেন ঠাকুর। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়ে রাত নেমে এলো।
এবার ঠাকুর অন্যত্র যাবেন। যাবার পথে বলে গেলেন ," মায়েরে তো মহাবৈদ্যে ধরছে, ওনার চিকিৎসার যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে সেইদিকে নজর রাখবেন" । সদ্য নামপ্রাপ্তা কন্যা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। (প্রসঙ্গত বলে রাখা ,তিনি ছিলেন প্রাচীন পন্থী।পরিবারভুক্ত কাহাকেও হাসপাতালে দেন নাই। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের এই সাবধান বাণীতে সচেতন হলেন তিনি। মেডিকেল হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে রেখেছিলেন কন্যাকে। সময়কালে একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েই কালের করাল গ্রাসে চলে গেলেন। শাস্ত্রী মহাশয়ের সব চেষ্টা, জলে কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলো।)
এই ব্যাবহারে মনোরঞ্জনবাবু অনুতাপ অনলে দগ্ধ হচ্ছিলেন। এতো বড়ো অন্যায় তিনি কি করে করে বসলেন । এমন তো আগে কখনো করেন নি। ঠাকুর কাষ্ঠের মতো সহিষ্ণু , সুদীর্ঘ সাহচর্যে তিনি নিশ্চিত করে বুঝেছিলেন, সব অপরাধ ই তাঁহার ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে ম্লান হয়ে যায়। শ্রীশ্রী ঠাকুর দ্রুতপদে চলছেন, অপরাধীর মতো পেছন পেছন চলছেন মনোরঞ্জন বাবু। বড়ো রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলেন ঠাকুর। মনোরঞ্জন বাবু গ্যাসের মৃদু আলোতে বুঝলেন বাগবাজারেরে কুখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতে তাঁরা প্রবেশ করেছেন। সম্ভ্রম বিসর্জন না দিয়ে এই পল্লীতে কোন ও ভদ্রজন তো প্রবেশ করেন না। নিরুপায় হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের পিছন পিছন প্রবেশ করলেন সেই ঘরে, যেখানে শায়িত কঙ্কালসার মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধা রমণী। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিতে হয়েছিলো এই নরক দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য। ও বৃদ্ধার শীর্ণ ললাটে ডান হাত রেখে ঠাকুর বললেন ," মা, ওমা , আমি আইছি,"।
বৃদ্ধা চোখ খুললেন অতি কষ্টে। অর্ধ্বস্ফুটস্বরে একটু উচ্চারণ করলেন , না _ রা _ সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আলো মুছে গেলো। ঠাকুর মনোরঞ্জন বাবুকে বাড়ী যেতে বললেন। মায়ের সৎকার্য্য না সেরে তিনি যেতে পারবেন না।অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতান্ত নিরুপায় হয়েই তিনি বাড়ী ফিরলেন। বিছানায় শুয়ে অন্তর-অনলে জ্বলছিলেন মনোরঞ্জন বাবু। সম্ভ্রম বাঁচাতে তিনি তো চলে এলেন ঠাকুরকে অসহায়ভাবে ফেলে রেখে। ঠাকুর মহাশয়ের কাছে কোনদিনও এক কপর্দকও থাকে না। অথচ সব কাজ না মিটিয়ে ঠাকুর কার ও ঘরে ফিরবেনও না।চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। কোন্ শ্মশানে গিয়েছেন তাও তো জানা নেই। আবার ভাবছেন , জানা থাকলেও তিনি কি করে যেতেন? মর্য্যাদার মেরু যেন তার সব পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। কান্না শুধু কান্নাই তার সম্বল। দুই তিনদিন বাদে অনেক চেষ্টার পর দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়ীতে ঠাকুর মহাশয়ের দর্শন পেলেন। ঠাকুরের চরণে পড়ে শুধু কাঁদলেন আর স্বীকার করে সমস্ত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলেন। সস্নেহে শ্রীশ্রীঠাকুর তার পিঠে হাত দিয়ে তুলে ধরলেন আর জানালেন কীভাবে মায়ের সৎকার সবাই প্রাণ দিয়ে করেছিলেন।
শুধু বড়োলোকের বাড়ীতেই ঠাকুর যেতে চান বলে অভিযোগ করেছিলেন কিন্তু প্রত্যক্ষ করলেন, নর-নারীর উপকারের উদ্দেশ্যেই সাধারণের অগম্য অতি হীন পতিত স্থানেও যেতে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। শুধুই কেঁদেছিলেন মনোরঞ্জন বাবু। একটু শান্ত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ' এ' কদিন কোথায় ছিলেন'? উত্তরে ঠাকুর বললেন, " ওখানের নরনারীরা সব ব্যায়ভার বহন করেছেন। তিনি কিছুই করতে পারেন নি। তাঁরাও তো মা। শ্যামবাজার অঞ্চলে ঠাকুরের পরিচিত একবাড়ীতে গিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন একটু টাকা চেয়ে এনে ওনাদের মিষ্টিমুখ করাবেন।
কিন্তু অত ভোরে দরজা খোলা নেই দেখে এক পান ওয়ালার কাছ থেকে পাঁচটাকা ধার নিয়ে রসগোল্লা কিনে ওনাদের মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। পরে হেসে বললেন ঠাকুর, " এমন ই অক্ষম , দু' দিন ধরে ভিক্ষা করে ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।" কতো ভাবে ঠাকুর নরের মাঝে সাধারন হয়ে শুধু মুক্তো ছড়িয়ে গেলেন। কুড়োতে পারলো কি কেউ? জয়রাম জয়রাম।
এমন অক্ষম শ্রী শ্রী ঠাকুর আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন নরসেবা আর অহংকারবর্জনের মহত্ত্ব। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে করুণার অমৃতধারা। আসুন, আমরা শ্রী শ্রী ঠাকুরের দেখানো পথে জীবনকে আলোকিত করি। জয়রাম জয়রাম।
#শ্রীশ্রীঠাকুর #নরসেবা #ঠাকুরেরবাণী #মানবতা #আধ্যাত্মিকতা #নরনারায়ণ #জয়রামজয়রাম #ঠাকুরেরকাহিনি
ঠাকুর শ্রী শ্রী রামঠাকুর, নরনারায়ণ, মানবতার শিক্ষা, আধ্যাত্মিক গল্প, করুণার কাহিনি, অহংকার বর্জন, ঠাকুরের সেবা, নরসেবা মহাসেবা, রামঠাকুরের জীবন, জয়রাম কীর্তন
No comments: