শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরের বাণীর ব্যাখ্যা (বেদবাণী ১/৯১)
মনের সুখদুঃখ দুইই বন্ধন, হিতাহিত শক্তি আবৃত থাকে। মনের নাশে ইন্দ্রিয় সুখের ভোগ হইতে অনন্ত সুখের উদয় করে, কস্মিনকালেও তাঁহার পরিবর্ত্তন হয় না। অতএব অতীন্দ্রিয় সুখের জন্য মনের(ইন্দ্রিয়ের) সুখ দুঃখ বেগ সহ্য করিতে চেষ্টা সর্ব্বদা করিতে ভুলিবেন না। ভালমন্দ, সুখ দুঃখ, শান্তিঅশান্তি কেবল ভ্রান্তি মনেরই গোচর। সকল ভার গুরুর উপর ন্যস্ত করিয়া হর্ষ, মর্ষ, পাপ তাপ, সংশয়াদি ক্রিয়া দ্বারা যথোৎপত্তি ভোগ সহ্য করিয়া সংসারের কার্য্য নিরপেক্ষ ভাবে সম্পাদন করিতে থাকিবেন, গুরুই সকল অভাব তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিবেন। শ্রীশ্রী রাম ঠাকুর বেদবাণী - ১/৯১
🔹
এই বাণী মনের প্রকৃতি, সুখ-দুঃখের দ্বৈততা, এবং আত্মিক আনন্দের পথ সম্পর্কে এক গভীর শিক্ষার বার্তা বহন করে। চলুন ধাপে ধাপে এর ব্যাখ্যা করি—
১️⃣ "মনের সুখদুঃখ দুইই বন্ধন, হিতাহিত শক্তি আবৃত থাকে।"
📖 অর্থ:
- সুখ এবং দুঃখ—এই দুই-ই বন্ধন (দাসত্ব) সৃষ্টি করে।
- এই দ্বৈততার কারণে মানুষ সত্য উপলব্ধি করতে পারে না।
- এই অবস্থায় মানুষের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা (হিতাহিত শক্তি) ঢেকে যায়।
🔹 আধ্যাত্মিক উপলব্ধি:
আমরা সাধারণত ভাবি সুখ ভালো, দুঃখ খারাপ—কিন্তু উভয়ই আসলে মোহের বন্ধন।
যখন মন এই সুখ-দুঃখের দ্বন্দ্বে আবদ্ধ থাকে, তখন সে সত্যিকারের আনন্দ (পরমসুখ) উপলব্ধি করতে পারে না।
২️⃣ "মনের নাশে ইন্দ্রিয় সুখের ভোগ হইতে অনন্ত সুখের উদয় করে, কস্মিনকালেও তাঁহার পরিবর্ত্তন হয় না।"
📖 অর্থ:
- যখন মন ধ্বংস হয় (অহং ও বাসনা মুক্ত হয়), তখন ইন্দ্রিয়গত সুখের মোহ কেটে যায়।
- এতে অনন্ত সুখের (অতীন্দ্রিয় সুখ) জন্ম হয়, যা চিরস্থায়ী এবং কখনও পরিবর্তিত হয় না।
🔹 আধ্যাত্মিক উপলব্ধি:
আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক) সবসময় ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছোটে।
কিন্তু এই ইন্দ্রিয়সুখ ক্ষণস্থায়ী এবং চিরকাল থাকে না।
যখন আমরা মনের আসক্তি থেকে মুক্তি পাই, তখন আত্মার আসল সুখ (পরমানন্দ) উপলব্ধি হয়।
৩️⃣ "অতএব অতীন্দ্রিয় সুখের জন্য মনের(ইন্দ্রিয়ের) সুখ দুঃখ বেগ সহ্য করিতে চেষ্টা সর্ব্বদা করিতে ভুলিবেন না।"
📖 অর্থ:
- অতীন্দ্রিয় (আত্মিক) সুখ লাভ করতে চাইলে, আমাদের মনের সুখ-দুঃখের প্রবাহ সহ্য করা শিখতে হবে।
- সবসময় ধৈর্য ধরে এই দ্বন্দ্বকে মোকাবিলা করতে হবে।
🔹 আধ্যাত্মিক উপলব্ধি:
জীবনে সুখ-দুঃখ আসবেই, কিন্তু যদি আমরা এগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারি, তবে সত্যিকারের আত্মিক সুখ লাভ করতে পারব।
অর্থাৎ, মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই আধ্যাত্মিকতার চাবিকাঠি।
৪️⃣ "ভালমন্দ, সুখ দুঃখ, শান্তিঅশান্তি কেবল ভ্রান্তি মনেরই গোচর।"
📖 অর্থ:
- ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি—এসব কেবল মনের সৃষ্টি করা বিভ্রম।
🔹 আধ্যাত্মিক উপলব্ধি:
আমরা যা ভালো বা খারাপ মনে করি, তা বাস্তব নয়—এগুলো কেবল মনের কল্পনা।
যদি আমরা মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারি, তবে এই বিভ্রম দূর হয়ে যাবে।
তখন আমাদের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি হবে এবং আমরা ভিতরের প্রশান্তি লাভ করব।
৫️⃣ "সকল ভার গুরুর উপর ন্যস্ত করিয়া হর্ষ, মর্ষ, পাপ তাপ, সংশয়াদি ক্রিয়া দ্বারা যথোৎপত্তি ভোগ সহ্য করিয়া সংসারের কার্য্য নিরপেক্ষ ভাবে সম্পাদন করিতে থাকিবেন, গুরুই সকল অভাব তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিবেন।"
📖 অর্থ:
- সকল দুঃখ-সুখ, পাপ-তাপ, সংশয়—সবকিছু গুরুর চরণে অর্পণ করুন।
- জীবনে যা কিছু ঘটে, তা ধৈর্য ধরে সহ্য করুন এবং দ Detached ভাবে নিজের কর্তব্য পালন করুন।
- গুরুই সকল সমস্যার সমাধান করবেন এবং আপনাকে মুক্ত করবেন।
🔹 আধ্যাত্মিক উপলব্ধি:
আমাদের উচিত গুরুতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখা এবং জীবনের ওঠা-নামা থেকে বিচলিত না হওয়া।
যখন আমরা আত্মসমর্পণ করি, তখন গুরু আমাদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমাদের সকল কষ্ট থেকে মুক্তি দেন।
🌿 সারসংক্ষেপ: শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরের শিক্ষা
✅ সুখ-দুঃখ উভয়ই বন্ধন—এগুলোতে আসক্ত হওয়া ঠিক নয়।
✅ আত্মার প্রকৃত সুখ ইন্দ্রিয় সুখের ঊর্ধ্বে—এই উপলব্ধি করতে হবে।
✅ ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ কেবল মনের কল্পনা—এগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
✅ গুরুর চরণে সমস্ত কিছু সমর্পণ করলে মুক্তি সম্ভব—এই বিশ্বাস নিয়ে জীবনযাপন করা উচিত।
🌸 শেষ কথা
এই শিক্ষা আমাদের জীবনে ধৈর্য, সহনশীলতা, এবং আত্মিক উন্নতি করতে সাহায্য করবে।
আমাদের মন যদি স্থির থাকে এবং আমরা গুরুর করুণা গ্রহণ করি, তবে সকল কষ্ট থেকে মুক্তি সম্ভব।
🙏 জয় গুরু! জয় শ্রীশ্রী রাম ঠাকুর! 🙏
.jpg)
No comments: