..............

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসংগে কিছু কথা

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসংগে কিছু কথা





“শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব” -    শ্রীসুশীলচন্দ্র দত্ত প্রণীত
১৯২৭ সনের কথা। তখন মাঝে মাঝে শ্রীশ্রীঠাকুর ঢাকার কোন কোন ভক্তের গৃহে আসতেন। অবশ্য তখন ঢাকায় ঠাকুরের ভক্তের সংখ্যা পাঁচ ছ’ জনের বেশী ছিলেন না। এঁদের মধ্যে স্বর্গীয় বীরেন্দ্র মজুমদার ছিলেন প্রাচীনতম। তখন বীরেন বাবু এবং শ্রীহরিদাস আচার্যের গৃহে গিয়েই কেহ কেহ শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করতেন। এরপর থেকে ঢাকায় ঠাকুরের ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ঠাকুরও মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন।
সময়ে অসময়ে সহসা শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তগৃহে পদার্পণ করতেন। তাঁহার পরনে থাকত আধময়লা কাপড় এবং গায়ে খদ্দরের নিমা বা একখানা সাধারণ চাদর। কখনো আবার নিমাটিও গায়ে থাকত না, শুধু একখানা চাদর গায়ে এসে উপস্থিত হতেন। হয়ত কোন দূর অঞ্চল ঘুরে ধূলি ধূসরিত নগ্ন  চরণে এসে দেখা দিতেন। কিন্তু কোথা থেকে কি অবস্থায় এলেন, সে কথা কখনো বলতেন না এমন কি শারীরিক ক্লেশ, সুবিধা-অসুবিধা, ক্ষুধা তৃষ্ণার কোন কথা বলারই অভ্যাস ছিল না। ভক্তগৃহের লোকেরা বাতাস করতেন, পা ধুইয়ে দিতেন এবং অনতিবিলম্বে কিছু ফলমূল আহারের ব্যবস্থা করতেন। ঠাকুরের তখন বাস্তবিক কি প্রয়োজন, তাহা তিনি কখনো প্রকাশ করতেন না।
নগ্ন গায়ে ঠাকুরকে দেখা যেত না। গায়ে কিছু না কিছু আবরণ থাকতই। দ্বিতীয় কোন পরিধেয় বা জামা চাদর তাঁহার সঙ্গে দেখা যায়নি। ঠাকুর এক-কাপড়েই চলাফেরা করতেন। কখনো ঠাকুরকে স্নান করতে দেখা যায়নি; কাজেই কাপড় বদলানোর বালাই তাঁর ছিল না। যদি ধোয়া একখানা কাপড় পরতে দিয়ে, ঠাকুরের ময়লা কাপড়খানা ধুইয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হত, তবে কাপড়খানা শুকিয়ে গেলে আবার যত্ন করে তা’ পরতেন, আর সাময়িকভাবে ব্যবহৃত কাপড়খানা ধীরে ধীরে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে যেতেন। সাধারণ ভাবেই মনে হতে পারে যে, দিনের পর দিন ব্যবহৃত কাপড়খানা নিশ্চয়ই যেমনি হত ময়লা, তেমনি হত দুর্গন্ধময়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হতো না । ঠাকুরের পরিহিত কাপড় কখনো বিশ্রী নোংরা হত না; আর দুর্গন্ধ হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাঁর পরনের কাপড় থেকে অতি মনোরম সৌরভ পাওয়া যেত।
কোন ভক্ত পরম আগ্রহে নূতন একখানা কাপড় দিয়ে উহা পরবার অনুরোধ জানালে ঠাকুর কাপড়খানা পরতেন এবং পুরনো কাপড়খানা সযত্নে ভাঁজ করে নিয়ে যেতেন। অনতিবিলম্বে হাতের  কাপড় কোন্ ফাঁকে কা’কে দিয়ে দিতেন। সময়ে সময়ে ভক্তগণ ঠাকুরের পরবার জন্য নূতন কাপড় দিলে উহা তখনই না পরে হাতে তুলে নিয়ে যেতেন। বলা বাহুল্য যে তাঁর হাতে ঐ কাপড় আর বেশীক্ষণ থাকত না। রাস্তায় চলতে কা’কে কোন্ ফাঁকে দিয়ে দিতেন। অনেক সময় ভক্তগণ ঠাকুরকে গরম কাপড়ের নিমা এবং শীতের সময় গায়ে দেবার জন্য মূল্যবান আলোয়ান দিতেন। কিন্তু ঐ সব গরম জামা কাপড় কোথায় বিলিয়ে দিয়ে আবার সেই নিমা গায়েই ঠাকুর ফিরে আসতেন।
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
শ্রীশ্রীঠাকুর গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী ছিলেন না। সাধারণ দীনবেশে জনসাধারণের মধ্যে আত্মাগোপন করে চলতেন। যদি বাহ্যিক ভাবে জটাজুটধারী, গেরুয়াপরিহিত, ত্রিশূল কমন্ডলুধারী সন্ন্যাসী হতেন, তবে রাস্তার লোক সরে দাঁড়াতে, ট্রেনে বেঞ্চ ছেড়ে দিত এবং ষ্টিমারে বিছানা এগিয়ে দিত। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর কারো কোন অসুবিধা বা কৌতুহলের সৃষ্টি না করে আপনভাবে চলাফেরা করতেন। তাঁর আদরের ভক্তগণ তাঁহার জন্য আরামের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সফল হননি, তাঁকে বেশভূষায় সাজাতে গিয়েও সাধ মেটাতে পারেননি।
কোন ভক্তের গৃহে উপস্থিত হলে ঠাকুরের জন্য ভক্ত তাঁর সাধ্যনুসারে নানাবিধ ফল, মিষ্টি, দই, দুধ, সরবৎ, ডাবের জল ইত্যাদি ব্যবস্থা করতেন। ভক্তের আহ্বানে ঠাকুর আসন গ্রহন করতেন। তারপর  গ্রহণ করতেন হয়ত একটি কলা একটু ঘি ও চিনির সঙ্গে। ভক্তের অনুরোধে কখনো দুধ বা ডাবের জলে চুমুক দিতেন। অবশিষ্ট প্রসাদ উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হত।
কোন ভক্ত ঠাকুরের জন্য বিশেষ যত্নে প্রাণের ঐকান্তিক আকাক্সক্ষায় কোন জিনিস তৈরী করলে ঠাকুর তা সাগ্রহে গ্রহণ করে ভক্তের আকাক্সক্ষা পূর্ণ করতেন।  ভোগলিপ্সা কোন্ যুগে ঠাকুরকে ত্যাগ করেছিল, তা কে আজ নির্ণয় করবে? এমন নিস্পৃহ, এমন সর্ব্বত্যাগী কি সচরাচর মর্ত্ত্যভূমে দেখা যায়?
শ্রীশ্রীঠাকুর অত্যন্ত দ্রুত হেঁটে পথ অতিক্রম করতেন। তাঁর সঙ্গে সমান তাল রেখে চলতে সকলে পারত  না। চলার পথে, গাড়ী আনা হচ্ছে বলে ঠাকুরের গতিরোধ করা যেত না। আগেই দরজায় গাড়ী এনে তবে ঠাকুরকে গাড়ীতে তুলতে হত। ঢাকা-নারায়গঞ্জের দশ মাইল রাস্তা অনেক সময় তিনি হেঁটেই চলে যেতেন। একটু পরেই ট্রেণ যাচ্ছে, এ কথা বলে ঠাকুরকে স্টেশনে বসিয়ে রাখা যেত না।
শ্রীশ্রীঠাকুর গৃহে আগমন করলে গৃহস্বামী স্বভাবতঃই একটু ব্যস্ত সাদর আহ্বান, উপযুক্ত আসন বা আদর-আপ্যায়নের অপেক্ষা রাখতেন না। শ্রীশ্রীঠাকুর উচ্চ বা নীচে যে কোন আসনে বসে পড়তেন। শুচি-অশুচি কোন কিছুর বাছবিচার করতেন না। অবশ্য ভক্ত শুদ্ধ ও পরিষ্কৃত আসনে ঠাকুরকে বসাতেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঠাকুর গৃহে উপস্থিত হলে সকলেই পরম উল্লাসিত হয়ে পড়তেন। সেদিন যেন গৃহে কোন অভাব-অভিযোগ নেই, কোন অশান্তি নেই। ছেলেমেয়েরাও যেন বুড়ো দাদুকে একেবারে পেয়ে বসত।
যদি কোন ভক্তগৃহে এসে ঠাকুর দেখতেন যে, একটি নূতন শিশুর জন্ম হয়েছে, তবে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তার ঠিকুজি লিখার জন্য। আর সে লেখাতে এমন তন্ময় হয়ে পড়তেন যে, সে সময় কেহ উপস্থিত হলে সেদিকে দৃক্পাতও করতেন না। কেহ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পেতেন না। সেই রকম আরব্ধ কর্ম্মে অভিনিবেশ ও তন্ময়তা কমই দেখা যায়।
দরিদ্র ভক্তের গ্রহে উপস্থিত হয়ে ঠাকুর কত ভাবেই না ভক্তকে অনুগৃহীত করতেন। ছোটখাটো কথা ও কাজে কেমন করে ভক্তের প্রাণ কেড়ে নিতেন! দরিদ্র ভক্তকে বলতেন, একটাকা নিয়ে বাজারে গেলে, বার আনার বাজার করে চার আনা ফিরিয়ে আনলে, আর একদিন বেশ চলতে পারে। গৃহিনীদের রান্নার আয়োজন দেখে কোন্টা কি দিয়ে কেমন করে রাঁধলে ভাল স্বাদ হবে, সে সব ধীরে ধীরে বাৎলে দিতেন। ভাঙ্গা কুলোটা দেখলে নিজের হাতে দু’টো গেরো দিয়ে দিতেন। বাড়ীর খোকাখুকীদের নিয়ে খেলা করতেন। শিশুদের নিয়ে ‘শিশু-সাথী’ পত্রিকার ছবি দেখতেন, আবার ওদের সঙ্গে হেসে কুটিপাটি হতেন।
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
ভক্তগণ সবাই জানেন যে, ঠাকুর নরনারী সকলকেই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। তাদের সঙ্গে পারিবারিক প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা করতেন। অনেক সময় তাদের ভর্ৎসনাও করতেন। কিন্তু তাদের প্রতি স্নেহপ্রদর্শনে কখনো কার্পণ্য করেননি।
ঠাকুরের অগণিত ভক্তের মধ্যে সকলেই কি নিষ্পাপ? নিশ্চয়ই তা নয়। কিন্তু দয়াল ঠাকুর কোন দিন কোন ভক্তকে তাহার বিসদৃশ আচরণ বা গর্হিত কর্ম্মের জন্য তাচ্ছিল্য করেন নি। বরং সকলেই মনে করতেন, - আমাকে ঠাকুর কতই স্নেহ করেন! পাপী ও পুণ্যবান ব্যক্তি সমভাবে ঠাকুরের স্নেহ ভালবাসা লাভ করেছেন। তাই আজ ভক্তগণ অশ্রুসিক্ত নয়নে পরম দয়াল ঠাকুরের কথা স্মরণ-মনন করে তাঁর করুনা ভিক্ষা করছেন।
কাঙ্গালের ঠাকুর দিনে পর দিন, মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপটু দেহ নিয়ে ভক্তদের দর্শন দিয়েছেন, জীবনপথে চলবার সহজ পথ নির্দেশ করেছেন, শোক-দুঃখের সময়ে আশ্বস্ত করেছেন এবং কত ভাবে আনন্দ বিতরণ করেছেন!
পূর্ব্বে নাম নিতে হলে অনেকেরই ধৈর্য্য-ধারণ করতে হত। কাকেও আবার বলতেন  এখানে আপনার পাওনা নাই; সময় হলেই হবে, ইত্যাদি। কাকেও হয়ত তার কুলগুরুর কাছ থেকেই নাম নিতে উপদেশ দিতেন। আবার কোন দীক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্ত মন্ত্রের সঙ্গে দু’একটি শব্দ যোগ করেও দিতেন। কুলগুরু যোগ্যব্যক্তি না হলেও ঠাকুর তাঁকে উপেক্ষা করতে বিশেষ ভাবে নিষেধ করতেন।পূর্ব্বে নামপ্রার্থীকে ঠাকুর কিছুক্ষণ তীব্র নজরে দেখতেন। মনে হয়, ঠাকুর নামপ্রার্থীদের সত্ত্বা নির্ণয় করতেন এবং ক্ষেত্রানুযায়ী অতি যত্নের সহিত নাম দিতেন। শুধু শ্রীমুখে নাম উচ্চারণ করতেন তাই নয়, কাগজে লিখে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করওে দিতেন। অবশ্য ঠাকুরের সেই গূঢ়তত্ত্বের ব্যাখ্যা অনেকেই সম্যক প্রণিধান করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। ঠাকুরের নিকট বারবার প্রার্থনা করেও অনেকে ধৈর্য্য ধরতে বাধ্য হয়েছেন। এরূপ একটি প্রার্থীকে তিনি কয়েকবার বলেছেনঃ সময় হইলে পাইবেন। ফলতঃ দেখা গেল সেই প্রার্থী স্বপ্নাবস্থায় নাম পেয়েছেন। কিন্তু সন্দিগ্ধমন শান্ত হয় না; ঠাকুরের কাছে স্বপ্নবৃত্তান্ত নিবেদন করলেন এবং তাঁর শ্রীমুখ হতে নামটি আবার শুনতে চাইলেন। অর্থাৎ যাচাই না করে স্বপ্নে প্রাপ্ত নামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস আসছে না। কিন্তু আশ্চর্য্য! ঠাকুর ঠিক সেই নামটি শ্রীমুখে উচ্চারণ করলেন, আর প্রার্থী ভক্তও পরম সন্তষ্টি লাভ করলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর গেরুয়া পরতেন না, তাঁর মাথা জটাজুটমন্ডিতছিল না, চিমটা-কমন্ডলু হাতে নিয়েও ফিরতেন না। বরং তাঁর পরনে ছিল সাদা পাড়হীন ধুতি, সামন্য একটি সাদা নিমা, এবং কখনো কখনো একখানা সাধারণ সাদা চাদর। অধিকন্তু কণ্ঠে ছিল তুলসীর মালা। তারপর অসংখ্য লোকের সম্মুখেই তিনি বৈষ্ণব-আচরিত নাম দিয়েছেন। বৈষ্ণবোচিত আচার অনুষ্ঠান, উৎসব কীর্ত্তন প্রভুতির সমর্থন ও উৎসাহ দিয়েছেন। নিজের মুখেও তিনি শ্রীগৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ প্রভু সম্পর্কে সঙ্গীতের বহু অংশ আবৃত্তি করতেন। কতবার হয়ত ভক্তগণ শ্রীমুখ হতে শুনতে পেয়েছেন, ‘নিতাই-পদ কমল, কোটি চন্দ্র সূশীতল; যায় ছায়ায় গেলে জগত জুড়ায়। হেন নিতাই বিনে ভাই, রাধাকৃষ্ণ পেতে নাই........ ইত্যাদি ইত্যাদি।’ ‘নাম নামী ভিন্ন নয়, ভজ নিষ্টা করি; নামের সহিত আছেন আপনি শ্রীহরি।’ সুতরাং শ্রীশ্রীঠাকুরকে মহাবৈষ্ণব মনে করবার যথেষ্টই কারণ ছিল। তাছাড়া আলাপ আলোচনা ও উপদেশচ্ছলে বৈষ্ণব মতের ও পথের অসংখ্য উপদেশ দিতেন।
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
শ্রীশ্রীঠাকুর যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই অসংখ্য নরনারী তাঁহার কাছ থেকে নাম গ্রহণ করেছেন। এমনকি বহু কিশোর বয়স্ক বালক- বালিকারাও নাম গ্রহণ করেছে। সকলেই প্রত্যক্ষ করেছেন যে, শেষকালে যেন ঠাকুর আর দ্বিধা করতেন না, যে কেহ নামপ্রার্থী হলেই তিনি সযন্তে নাম দিতেন। কিন্তু পূর্বে এরূপ দেখা যায় নি। আমরা জানি শ্রীশ্রীঠাকুর শুধু বৈষ্ণব মন্ত্রেই দীক্ষা দেন নাই। তিনি শক্তিমন্ত্রেও দীক্ষা দিয়েছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের বহু ভক্ত প্রণব মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেছেন।
এইরূপে নাম গ্রহণের ফলে বর্ত্তমান সময়ে বাংলা, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঠাকুরের ভক্ত বা আশ্রিতের সংখ্যা লক্ষাধিক দাঁড়িয়েছে, ইহা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
আমরা মোহান্ধ, কাজেই দ্বিধা ও সংশয় আমাদের চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করতে পারে। অনেক সময় হয়ত মনে হতে পারে, ঠাকুরের কৃপায় নাম তো পেয়েছি, এর ফল কতদূর কি হবে? নাম নিয়ে ত যথারীতি নামের অনুশীলন করা হচ্ছে না, কাজেই ফললাভ কেমন করে হবে? কিন্তু দৃঢ়তার সহিত এ কথা বলা যেতে পারে যে যাঁরা, শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত নামে ও নির্দ্দেশে অবিচল অবস্থা স্থাপন করেছেন এবং তাঁর কৃপার ভিখারী হয়ে নাম নিয়ে পড়ে আছেন, তাঁরা দৈনন্দিন জীবনের প্রতিক্ষেত্রে শ্রীশ্রীঠাকুরের অসীম করুণার আভাস মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করে আনন্দসাগরে নিমজ্জিত আছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তাঁর বহু ভক্ত এবং তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা-সম্পন্ন নরনারী আসতেন ঔষধের ব্যবস্থার জন্য। হাঁপানী, যক্ষ্মা, সৃতিকা, শূলব্যথা প্রভৃতি রোগের কত রোগী তাদের করুণ আবেদন ঠাকুরকে জানাতেন। আবার মেয়ের বিয়ে, ছেলের পরীক্ষা, পারিবারিক অশান্তি, সরিকী মামলা, তদানীন্তন পুলিশের অত্যাচার  প্রভৃতির ব্যাপারে নিয়েও অনেকে ঠাকুরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেন। অনেকে ঠাকুরের সৎ প্রসঙ্গ বা তাঁর বিশ্রামের ব্যাঘাত করেও নিতান্ত অবিবেচকের মত প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। কিন্তু ঠাকুরকে কখনো কাহারো প্রতি বিরক্ত হতে দেখিনি। বরং বিরক্ত হওয়া দূরে থাক, তিনি অতি আগ্রহের সহিত সবার বক্তব্যই শুনতেন। রোগীর আকুল আবেদনে ঠাকুর করুণার্দ্র উঠতেন এবং তৎক্ষণাৎ ঔষধের ব্যবস্থা করে দিতেন বা যাহাকে যে উপদেশ দেওয়া দরকার তা যত্নের সঙ্গেই দিতেন।  যে সকল রোগী পরম আগ্রহে এবং শ্রদ্ধার সহিত আর্শীবাদরূপে ঔষধ ব্যবহারে করতেন, তারা অচিরে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হতেন। ঠাকুর কেবল গাছগাছড়া বা তৈলাদির ব্যবস্থা দিতেন, তা নয়। সকালে সন্ধ্যায় ভ্রমণ, কিছু ব্যায়ামের অভ্যাসের ব্যবস্থাও দিতেন।
একবার একটি বি.এস্, সি. পড়ুয়া ছেলে ঠাকুরের কাছে এসে নিবেদন করল যে, তার পেটে সময়ে সময়ে অসহ্য ব্যথা হয়। এজন্য এক্সরে করিয়ে কলকাতায় বড় ডাক্তার ঔষধের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কিছুতে রোগের শান্তি হচ্ছে না। ঠাকুর ছেলেটির দিকে চেয়ে সস্নেহে বললেন, আপনি আপনাদের ঠাকুর ঘরে বসে নিত্য হরিনাম করবেন। ছেলেছির কোন নামে আসক্তি ছিল না এবং সঙ্গীতে সামান্য দক্ষতাও ছিল না। কিন্তু সে ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে প্রত্যহ সন্ধ্যায় ঠাকুর ঘরে বসে অনুচ্চ কণ্ঠে নাম করত। কিছুদিন পরেই সে তীব্র যাতনা থেকে মুক্তি পায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করে দিতেন। তখন তাঁহার কৃপার ভাবটি লক্ষ্য করে সকলকেই মুগ্ধ হ’তে হত। তিনি অর্ন্তদৃষ্টিতে যার মৃত্যু অনিবার্য জানতেন, তখন তাঁহার আচরণ সাধারণ দৃষ্টিতে যেন নির্মম বলে মনে হত। আবার বহুদূর থেকেও প্রিয় শিষ্যের ব্যাধির প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন এবং অভয় দিতেন।
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
রোগীদের রোগমুক্তির ব্যবস্থা ঠাকুর অম্লান চিত্তে করতেন; কিন্তু নিজে ব্যধিগ্রস্থ হলে কোন্ ব্যবস্থায় তিনি নিরাময় হবেন, তা কখনো বলতেন না। বরং ধৈর্য্য ধরে ভোগকাল অতিবাহিত করতেন। অবশ্য ভক্তেরা তাঁহার অসুখের সময় যে ব্যবস্থাই করুন না কেন, তাতে কোন বাধা দিতেন না।
অনেক সময় ভক্তগণ আলোচনা করতেন যে, ঠাকুরের নিষ্পাপ দেহে এমন কঠিন বাত রোগ কেমন করে প্রবেশ করল? কোন কোন ভক্ত এমনও বলেছেন যে, শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের ব্যাধি নিজের দেহে গ্রহণ করে তাদের রোগমুক্ত করেছেন। বিশিষ্ট ভক্তদের মুখে শুনা যায়, ঠাকুর নাকি উত্তর প্রদেশের কোন বিত্তশালী ব্যক্তির একমাত্র পুত্রের বাত রোগ নিজ দেহে গ্রহণ করে ছেলেছিকে রোগমুক্ত করেছিলেন। সেই কঠিন বাতরোগ নিজেও মাঝে মাঝে ভূগে থাকেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর কত সময়ে বলতেন, ‘সর্বদা আনন্দে থাকবেন।’ ভক্তদের আনন্দের সুযোগ দিতে কখনো তিনি দ্বিধা করেন নি। বরং ক্ষুদ্র বিষয়েও ভক্তগণ আনন্দ করেছেন দেখলে ঠ’কুর কতই খুশী হতেন ক্রুটি বিচ্যুতি দেখলেও কখনো ভৎসর্না করতেন না। প্রয়োজনবোধে মিষ্ট বাক্যে সাবধান করে দিতেন এবং ধীরভাবে উপদেশ দিতেন।
সাধারণ দৃষ্টিতে শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন অতি শান্ত। ভক্তগৃহে, উৎসব- সমারোহে ধীর, স্থির,। নির্বিকারে সর্ব্বত্র চলাফেরা করতেন। সর্ব্বদা সংযত ভাব। বাহ্য জগৎ তরঙ্গ-বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের মত দৃষ্ট হলেও, ঠাকুর ছিলেন মহাসমুদ্রের তলদেশের ন্যায় শান্ত ও স্থির। ভক্ত ও দর্শনার্থিগণ স্বার্থ-পরার্থের কত প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করতেন। ঠাকুর ধৈর্য্যসহকারে প্রত্যেকটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে তাহাদের সংশয় ভঞ্জন করতেন। অমায়িক ব্যবহারে এবং স্নেহের সম্বোধনে উপস্থিত জনগণের অন্তরে যেন একটা পরম শান্তির প্রলেপ দিয়ে দিতেন।
আবার এই চিরক্ষমাশীল ও স্নেহপ্রাণ ঠাকুরও কঠোর ও নির্মম ব্যবহার করতেন- উহা কেহ প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতে চাইতেন না। কেন তিনি নির্মম ও কঠোর হতেন, তাহা সাধারণের বুদ্ধির অগম্য ছিল। ঠাকুর অন্তর্দৃষ্টির বলে যাহা দেখতেন এবং বুঝতেন, তা অপরের পক্ষে অনুধাবন করা কখনো সম্ভব ছিল না। তিনি শ্রীমুখে যেমন বলতেন, ‘প্রাক্তনের ভোগদান করতেই হবে,’ কার্য্যওে তিনি প্রিয় ভক্তের বিপর্যয় কালে অবিচলিত থাকতেন। আমরা যাহাকে কঠোর আখ্যা দিতাম, সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষের দৃষ্টিতে তাহা হয়ত ন্যায় ও কল্যাণ-রূপে প্রতিভাত হত। এজন্য অনেক সময় মনে হয়, বাহ্যিক ভাবে আমরা ঠাকুরকে যেরূপ দেখতাম বা ভাবতাম, তিনি তাহার অনেক উর্ধ্বে অন্তর্লোকে বাস করতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর সম্পর্কে এই বৈষম্যের প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন, স্নেহশীল, ধৈর্যশীল, কোমল; আবার ছিলেন তেজস্বী কখনো নির্মম, নিষ্ঠুর। বহুভাবে ঠাকুরকে দেখবার যাদের সুযোগ হয়েছিল, তাঁরা নিশ্চয় একথা স্বীকার করবেন। মুখে তিনি অনেক কিছুই বলেননি, কিন্তু কার্য্যত তিনি দেখিয়াছেন যে, মানুষের দুর্বলতার কোন দিকই তাঁর দৃষ্টি এড়ায় নি।
সমাজে যারা নিতান্ত দুর্নীতিপরায়ন ও চরিত্রভ্রষ্ট বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরাও ঠাকুরের করুণালাভে বঞ্চিত হননি। ঠাকুর কখনো কারো চরিত্রহীনতার জন্য ভৎর্সনা করতেন না বা নাম প্রদানে কার্পণ্য করতেন না। সময়ে নামের দিব্য প্রভাবে চরিত্রের পরিবর্তন হত বলেই বিশ্বাস করি। শ্রীশ্রীঠাকুর নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, পতিতের নির্ভর এবং কাঙালে দয়াল ঠাকুর।
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
শ্রীশ্রীঠাকুর নামকীর্ত্তনের উৎসাহ দিতেন। তাঁর শুভাগমন হলেই ভক্তগণ কীর্ত্তনের ব্যবস্থা করতেন। কীর্ত্তন আরম্ভ হলে ঠাকুর স্থিরভাবে উপবিষ্ট থাকতেন এবং সময় সময় কীর্ত্তন জমাট হয়ে উঠলে ঠাকুরের দেহ দুলে উঠত। আসর-বন্দনা থেকে প্রেমধ্বনি পর্য্যন্ত নিয়ম যথারীতি প্রতিপালনের তিনি পক্ষপাতি ছিলেন। কীর্ত্তন আরম্ভ হলে মাঝখানে বিরতি, কেনরূপ আলোচনা, প্রভৃতি পছন্দ করতেন না।
নরনারীর বিবাহ বন্ধনকে ঠাকুর উচ্চস্থান দিতেন। তিনি বলতেন, ‘দাম্পত্য প্রণয়ে ভগবান বাস করেন’। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা এবং সংযমহীনতা আদৌ পছন্দ করতেন না।
নারীজতির প্রতি তাঁর সদয় ছিল অপরিসীম। দরিদ্রের সংসারে তাঁরা কত ভাবেই দুঃখ ভোগ করেন। অভাবগ্রস্ত, শোকতাপে জর্জ্জরিত মহিলাদের তিনি কত ভাবেই আশ^স্ত করতেন! শত দুঃখের মধ্যেও তাঁদের বলতেন, ‘সংসার করবেন, নাম করবেন, আনন্দ করবেন’। দরিদ্র ও নানা প্রকার কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন বলে কোনদিন তাঁদের উপেক্ষা করেননি। বরং তাদের কুটিরে গিয়ে ঠাকুর কত স্বস্তি বোধ করতেন। কোন কোন ধনবানের গৃহে ঐশ্বর্য্যরে বিকাশের মধ্যে ঠাকুর যেন অস্বস্তি বোধ করতেন। আবার কেহ কেহ বেশ উপলব্ধি করেছেন যে তাঁর আশীর্বাদে সম্পদ ও আনন্দ লাভ করে তাহারা কৃতার্থ হয়েছেন।
অধিকাংশ হিন্দুগৃহেই শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর আসন স্থাপিত আছে। নিত্যপূজা ছাড়াও মেয়েরা বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠান্তে পূজা করে থাকেন। ঠাকুর এই প্রথার বিশেষ প্রশংসা করতেন। তিনি বলতেন, ‘শ্রদ্ধাভক্তিসহ লক্ষ্মীপূজা করলে লক্ষ্মীর কৃপালাভ হয়, কোন অভাব থাকে না।
মেয়েদের ভেতর সাদাসিদে ভাবটি ঠাকুর পছন্দ করতেন। যে কোন গৃহের মেয়েদের সরলতা এবং আদর-আপ্যায়ন ঠাকুরকে বিশেষ মুগ্ধ করত। আধুনিকাদের পোষাকের ঠাঁট এবং কৃত্রিমতা তিনি তেমন প্রীতির চক্ষে দেখতেন বলে মনে হয় না। কোন একটি সাদাসিধে মহিলা সম্পর্কে ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘এমন পবিত্র মেয়ে কম দেখা যায়।’
শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র কাহিনী স্পষ্টভাবে কাকেও বলেছেন কিনা জানি না। তাঁর পরবর্তী জবিনের গতিবিধি দেখে মনে হত যে তিনি চিরদিনই লুকিয়ে চলতেন। আত্মা-প্রকাশ বা প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র আকাক্সক্ষা তাঁর ছিল না। মাঝে মাঝে নেহাৎ দু’একটি ঘটনা অন্তরঙ্গ শিষ্যদের যেন অজ্ঞাতসারে বলে ফেলতেন। ঐ সকল ক্ষুদ্র বিছিন্ন কাহিনী থেকে ভক্তগণ ঠাকুরের অপূর্ব ও বিচিত্র জীবনের আভাস পেতে পারতেন; যে সকল ভক্ত ঠাকুরের দিব্যজীবনের সম্বন্ধে চিন্তা করে থাকেন, তাঁরা ঐ সকল খন্ডিত কাহিনী বা ঘটনা হতে অনেক উপকরণ সংগ্রহ করতে পারবেন। তাঁর বিবৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনীতে কোন আমিত্বের আভাস থাকতো না। ঠাকুর এমনভাবে ঘটনার বর্ণনা করতেন, যেন অপর কোন সাধুর জীবনে ঐ সকল ব্যাপার ঘটেছে।
একদিন হঠাৎ বলে উঠলেন দেশপ্রেমিক স্বর্গীয় অশ্বিনীকুমার দত্তের কথা। ঠাকুর বললেন, ‘পূর্বজন্মে অশ্বিনীবাবু ছিলেন হিমালয় প্রবাসী কঠোর সাধক; দেহ ছিল তাঁর বরফে সাদা। কিন্তু দেশ-সেবার  আকাঙক্ষা ছিল তাঁর। তাই তো দেশের জন্য অনেক কিছু করে গেলেন এ জন্মে।’
(শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানুন- কৈবল্য ভুবনের সাথে থাকুন। )
ঠাকুর অনেক সময় গুরুগণের সেবায় বিষয়ে কিছু কিছু বলতেন। বছর একবার গুরুগণের সেবার ভার ঠাকুরের উপর পড়ত। এজন্য তিনি ভক্তদের নিকট হতে কিছু কিছু অর্থও চেয়ে নিতেন। সারারাতি কোথায় যেন গুরুগণের সেবার ব্যাপারে ব্যাপৃত থেকে ভোর বেলায় ক্লান্তদেহে ঠাকুর ফিরে আসতেন। এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে শুধু এই- টুকু জানা গিয়েছিল যে, সমবেত গুরুগণের সেবার জন্য একটি হাঁড়িতে নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য সহযোগে অমৃতভোগ তৈরী হয় এবং গুরুগণ আনন্দ সহাকারে উহা গ্রহণ করেন। এর পরিপূর্ণ তাৎপর্য্য কি, তা রহস্যবৃত বলেই মনে হয়।
একবার জনৈক ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘আপনাদের ঠাকুরকে নবাবুপর রোডে (ঢাকা) মালিটোলার ওখানে দেখে এলাম।’ কথাটা শুনে আমাদের ধাঁধাঁ লেগে গেল। কেননা, আমরা নিশ্চিতরূপে জানতাম যে ঠাকুর আগের দিন ময়মনসিংহ সহরে সতীনবাবুর বাসায় চলে গেছেন এবং সেখানেই আছেন।
একই সময়ে দুইস্থানে ঠাকুরের অবস্থান নিয়ে তখন আলোচনা হত এবং অনেকেই বিভ্রান্ত বোধ করতেন। এ বিষয়ে ঠাকুরকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘অমন হয়, ওতে মন দেবার কোন দরকার নাই’।
অনেক সময় ঠাকুর ভক্তগৃহে চাদর মুড়িদিয়া নিশ্চল অবস্থায় শুয়ে থাকতেন। সে অবস্থায় ভক্তগণ বলতেন, ‘ঠাকুরের দেহ এখানে রয়েছে কিন্তু ঠাকুর এখানে নেই। হয়ত কোন গুরুতর প্রয়োজনে কোথায় যেন চলে গেছেন’। এরূপ নিশ্চল অবস্থায় কেউ তাঁকে ডাকতে সাহস করেন নাই। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে, আবার ধীরে ধীরে ঠাকুর উঠে বসতেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন কিশোর বয়স থেকেই সর্ব্বত্যাগী। তাঁর কোন কিছুর প্রয়োজন ছিল না এবং অভাববোধ ছিল না। খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়- যা মানুষের জীবনে অপরিহার্য্য- এর কোনটিরই প্রয়োজনবোধ তিনি করেন নি। সমগ্র জীবনের প্রায় ৭০ বৎসর তিনি এমনি আশ্রয়হীন ও অবলম্বনহীন হয়ে ভারতে এবং বহির্ভারতে পরিক্রমণ করেছেন। বাহ্যিকভাবে সাধুত্বের কোন নিদর্শনও ছিল না। সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে, এ অস্বাভাবিক বা অসম্ভব বলেই মনে হয়।
ভক্তিমান আদর্শ গৃহী মাধব চক্রবর্তী ও পরম ভক্তিমর্তী কমলা দেবীর যমজ পুত্রের একটি রাম, অপরটি লক্ষ্মণ। যমজ পুত্র দু’টি ছিল জনকজননীর নয়নের মণি। ঠাকুরের অনুজ লক্ষ্মণ ছিলেন অতিশয় আত্মাভোলা। তাঁহার নিকট আপন-পর বিচার ছিল না। তাঁর অকাল মৃত্যুতে পরিবারস্থ সকলেই শোকার্ত্ত হয়েছিলেন। লক্ষ্মণ ঠাকুর বাড়ী হতে কুমিল্লায় ভ্রমণব্যপদেশে গিয়েছিলেন এবং সেখানে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। এই দুঃসংবাদ বাড়ীতে আত্মীয়- স্বজনের নিকট পৌঁছবার পূর্বেই শ্রীশ্রীঠাকুর কাশীধাম হতে লক্ষ্মণের মৃত্যু সংবাদ বাড়ীতে জানিয়ে দেন। লক্ষ্মণ ঠাকুরের প্রসঙ্গ আরম্ভ হলে ঠাকুর যেন একটু বিচলিত হয়ে পড়তেন। ভ্রাতা লক্ষ্মণের প্রতি ঠাকুরের একটা প্রবল স্নেহের টান ছিল।
আপন পরিবারের তথা বংশের সহিত ওতপ্রোতভাবে ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও ঠাকুর এই সম্পর্ককে চিরদিনের মত ছিন্ন করেন নি। যৌবন বয়স পর্যন্ত তিনি জন্মভূমি ফরিদপুর জেলার ডিঙ্গামাণিক গ্রামে যাওয়া আসা করতেন। নিজ বংশের কারো কারো প্রতি ঠাকুরের অকৃত্রিম স্নেহ দেখা যেত। তাদের কল্যাণের জন্য বৈষয়িক ব্যাপারেও উপদেশ দিতেন; আবার প্রয়োজনবোধে ভৎর্সনাও করতেন। 
কুলগুরুর প্রতি ঠাকুর যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার ঢাকার ভক্তগৃহে ঠাকুরের উপস্থিত সময়ে তাঁর কুলগুরু বংশের একটি ব্রাহ্মণ উপস্থিত হন। ঠাকুর তাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে উচ্চ আসনে বসিয়ে নিজে অন্যান্য সকলের সাথে সতরঞ্চের উপর বসে পড়লেন। অতি বিনীতভাবে তাঁর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর অধিকাংশ সময়েই ভগবৎপ্রসঙ্গ নিয়ে থাকতেন। ভক্তগণ সাধারণ বিষয়ের অবতারনা করলেও তিনি তাঁহার দিব্যদৃষ্টিতে গূঢ়তত্ত্ব দ্বারা উহার বিশ্লেষণ করতেন। ঠাকুর সহজভাবে তত্ত্বকথার মীমাংসা করতেন, কিন্তু ভক্তগণ উহা আড়ষ্ট ও দুর্বোধ মনে করতেন। নাম মাহাত্ম্য, সাধনতত্ত্ব, ভগবৎলীলা, বৃন্দাবনলীলা, রাসলীলা প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও আলোচনা যে ভাবে ও ভাষার প্রকাশ করতেন, তাহা সাধারণের পক্ষে কেন, বৈদান্তিকগণের কাছেও দুরূহ বলে মনে হত।

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসংগে কিছু কথা শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসংগে কিছু কথা Reviewed by SRISRI RAMTHAKUR KOTHA O BANI YOUTUBE CHANNEL on 18:45 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.