..............

ঠাকুরমহাশয় সস্নেহে বললেন, "ওতে কোন দোষ হয় না।

স্বর্গীয় সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডা. জে.এম.দাশগুপ্ত মহাশয় তখন অবিভক্ত বঙ্গদেশের কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন।
মহাত্মা গান্ধীর আহবানে ওয়ার্ধা যাত্রার কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন,ঠাকুরমহাশয় অনেকদিন পরে কোলকাতায় এসেছেন এবং মতিবাবুর বাড়িতে কয়েকদিন থাকবেন।আকুল হয়ে উঠল ডা. দাশগুপ্তের মন।কিন্তু তখন তিনি নিরুপায়।দিন কয়েক বাদে তিনি কোলকাতায় ফিরলেন।
কংগ্রেস অফিসে জরুরী সভা করে বেলা বারটা নাগাদ তিনি মতিবাবুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন।ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন।

কয়েকটি কথার পরই ঠাকুরমহাশয় তাকে বললেন, "আইজ আপনি দুপুরে এইখানেই স্নান-আহার করবেন।"
ডা. দাশগুপ্ত বিনীতভাবে করজোড়ে জানালেন যে বাড়িতে ওরা খুব চিন্তায় থাকবে।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরমহাশয় বললেন, "আপনার ড্রাইভারকে পাঠাইয়া দেন;সে বাড়িতে খবর দিয়া আসুক।" ডাক্তারবাবু ছুটে রাস্তায় গেলেন-পিছনে পিছনে ঠাকুরমহাশয়ও ছুটলেন।ডাক্তারবাবুকে বললেন, "ড্রাইভার ফেরার সময় যেন দুই প্যাকেট 'গোল্ড-ফ্লেক' সিগারেট কিনে আনেন।ওকে দাম দিয়া দেন।"
ডাক্তারবাবু ধূমপান করতেন না,মতিবাবুও তাই।সুতরাং সিগারেট কার জন্য কেনা।ডাক্তারবাবু ড্রাইভারকে সিগারেট আনার টাকা দিলেন।কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর তার মুখ থেকে মুছে গেল না।
ঘরে ফেরার পর ডা. দাশগুপ্ত স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।ইতিমধ্যে ঠাকুরমহাশয় মতিবাবুর সহধর্মিণীর কাছ থেকে চেয়ে আনা এক খাবলা তেল ডাক্তারবাবুর মাথায় ধীরে ধীরে ঘষছেন।দু'পা পিছিয়ে গেলেন ডাক্তার দাশগুপ্ত।সানুনয়ে বললেন, "বাবা ওটা করবেন না।আপনি হাত ধুয়ে ফেলুন।আমি মাথায় তেল মেখে নিচ্ছি।"
ডাক্তার দাশগুপ্ত টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে দেখলেন যে ঠাকুরমহাশয় পাম্প করে এক বালতি জল প্রায় তুলে ফেলেছেন এবং বললেন, "আমি পাম্প করি,আপনি ভাল কইর‍্যা স্নান করেন।" এবার ডা. দাশগুপ্ত বাধ্য হয়ে ঠাকুরমহাশয়ের হাত দু'টি জড়িয়ে ধরে বললেন, "বাবা,আপনি জল তুলবেন,আর আমি স্নান করব,এ কখনই হতে পারে না।আমি তা হলে আজ আর স্নানই করব না।" ঠাকুরমহাশয় সস্নেহে বললেন, "ওতে কোন দোষ হয় না।" তখন ডাক্তার দাশগুপ্ত জানালেন, "আপনি ঘরে না বসলে আমি স্নান শুরু করব না।" ঠাকুরমহাশয় ঘরে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাদে ডাক্তার দাশগুপ্ত স্নান শেষে ঐ ঘরে এসে ঢুকলেন।সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন মতিবাবু তার দোকান থেকে।ক্ষণপরে আসিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের ভূতপূর্ব আশুতোষ অধ্যাপক স্বর্গীয় ডক্টর প্রভাতচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয়।
প্রভাতচন্দ্র ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করতেই ঠাকুরমহাশয় মতিবাবুর স্ত্রীকে ডেকে বললেন,মাথার তেল আনতে।আর প্রভাতচন্দ্রকে বললেন, "আপনি আইজ দুপুরবেলা এইখানেই দুইটা আহার করবেন।" প্রভাতচন্দ্র জানালেন,সকালবেলা তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়েছেন,স্নান করেননি।সুতরাং এখন তিনি স্নান করবেন।কিন্তু এখানে খাবেন না,কারণ তিনি জানতেন মতিবাবু নিরামিষাশী।
ঠাকুরকে জানালেন,নিরামিষ খেয়ে তার পেট ভরবে না।মতিবাবু পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, "আজ আর সেই ভয় নেই।কারণ অতি প্রত্যুষেই ঠাকুরমহাশয় তাকে দিয়ে একটা বড় চিতল মাছের পেটি আর এক কুড়ি বুক-লাল কই মাছ আনিয়েছেন।" উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন প্রভাতচন্দ্র।তিনি জানতেন মতিবাবুর সহধর্মিণী রন্ধনকর্মে অতি সুনিপুণা ছিলেন।
উঠে এলেন ঠাকুরমহাশয়।প্রভাতচন্দ্রকে বললেন, "চলেন টিউবওয়েলের কাছে,আপনাকে স্নান করাইয়া আনি।" ডা. দাশগুপ্ত ঠাকুরমহাশয়কে প্রতিনিবৃত্ত করে বললেন, "আপনি বসুন বাবা।আমি প্রভাতবাবুকে স্নান করিয়ে আনছি।"
ডাক্তারবাবু,প্রভাতচন্দ্র এবং মতিবাবু একসঙ্গে আহারে বসলেন।ঠাকুরমহাশয় সামনে একটি মোড়ায় বসে ওনাদের আহার করা দেখছিলেন আর বলছিলেন মতিবাবুর সহধর্মিণীকে, "আরও দেন, আরও দেন,মা।" প্রভাতচন্দ্র মতিবাবুকে একবার বললেন যে আপনি শুধু মাছ কিনেই আনলেন-খেলেন তো না।" ডাক্তারদা,আপনে আমি ভরসা।ঠাকুরমহাশয় যে মাছ কিনিয়েছেন আর বৌঠান কষ্ট করে যাহা রান্না করেছেন তার কিছুমাত্র যেন না পড়ে থাকে।
পরম তৃপ্তির সহিত ভোজনের পর প্রভাতচন্দ্র নিজের কোটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই লুকিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অনতিদূরে একটি গাছের তলায় গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুললেন।প্যাকেটে একটা সিগারেটও নেই।ছুটতে ছুটতে ডা. দাশগুপ্ত প্রভাতচন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন।ততঃক্ষণ প্রভাতচন্দ্র খালি প্যাকেটটা মাটিতে ফেলে দিয়েছেন।
ডা. দাশগুপ্ত হাত বাড়িয়ে ঐ দুই প্যাকেট সিগারেট তার হাতে দিলেন।প্রভাতচন্দ্র ক্ষণকাল বিস্মিত হয়ে ডা. দাশগুপ্তের মুখের দিকে তাকালেন।তখন ডা. দাশগুপ্ত ঐ সিগারেট আনার আগেকার কথাটা জানালেন।
প্রভাতচন্দ্র অতি ধীরে সিগারেট টানছিলেন কম্পমান হস্তে,নির্বাক হয়ে।সহসা ডাক্তারবাবু বললেন, "আপনার পারমিশন নিয়ে একটা কাজ করব, ভাই? আপনার পকেটে হাত দিয়ে একটু দেখব,আপনার কি 'পার্স' সঙ্গে আছে?" প্রভাতচন্দ্র বললেন যে আপনি দাদা-বড় ভাই।আপনি আমার কাছে কোনও বিষয়েই অনুমতি চাইবেন না।
কিছুক্ষণ পরে হাসতে হাসতে ডাক্তার দাশগুপ্ত প্রভাতচন্দ্রের সামনে উপস্থিত হলেন আর বললেন, "প্রভাতবাবু, ঠাকুরমহাশয় ঠিকই বলেছিলেন,আপনার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পয়সাও নেই পকেটে।দু'টি মাত্র তামার পয়সা পড়ে আছে।" তখন প্রভাতচন্দ্র বহুবাজার অঞ্চলে বাস করতেন, ডাক্তার দাশগুপ্তকে বললেন, "সকালবেলা তিনি তার এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করার জন্য শিয়ালদা অঞ্চলে গিয়েছিলেন।ফেরার সময় ঠাকুরের জনৈক আশ্রিত তাহাকে জানিয়েছিলেন ঠাকুরমহাশয় মতিদার বাড়িতে আছেন।খবর পেয়ে তিনি আর বাড়িমুখো না হয়ে সোজা শিয়ালদা স্টেশনে এসে ঢাকুরিয়ার একখানা টিকিট কেটে মতিবাবুর বাড়ি এসে পৌছেছেন।পয়সার যে প্রয়োজন পড়বে সেটা তিনি পূর্বে জানতেন না।তাই তিনি ওকথা ভাবেনওনি।"
ইতিমধ্যে মতিবাবুও সেখানে এসে উপস্থিত।তিনিও সব শুনলেন এবং সকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলেন।ডাক্তার দাশগুপ্ত পুনরায় জানালেন যে ঠাকুরমহাশয় বহুক্ষণ আগেই তাকে বলেছেন যে প্রভাতবাবুর সঙ্গে তার ফিরে যাওয়ারও পয়সা নেই।আমি যেন আপনাকে আমার গাড়ি করে বাড়ি পর্য্যন্ত পৌছে দেই।
অর্ধদগ্ধ সিগারেটটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে অর্ধ-উন্মাদের মত জল-ভরা চোখে ছুটলেন প্রভাতচন্দ্র।
ঠাকুরমহাশয়ের চরণে লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করে বললেন, "অপাত্রে আমার মত পাপিষ্ঠের জন্য এত করুণা কেন? ডাক্তারবাবু ভক্ত লোক,তার জন্য চিতল মাছের ব্যবস্থা করেছেন তা খুবই উপযুক্ত।আমি কই মাছ ভালবাসি আমার জন্য আবার কই কেন আনালেন? আমাদের জন্য আপনি তো প্রতিদিনই অনেক কষ্ট ভোগ করেন।কিন্তু আমি কি কখনও আপনাকে স্মরণ করি?" কাঁদছিলেন ডাক্তারবাবু,কাঁদছিলেন মতিবাবুও আর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মতিবাবুর সহধর্মিণী।
ঠাকুরমহাশয় স্থির,অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন।বললেন, "আপনারা আমারে কত স্নেহ করেন-ভালবাসেন।আমারও তো ইচ্ছা করে,আপনারা একটু ভাল কইরা খাওয়া দাওয়া করেন,আর আমি দেখি।"
সহসা মতিবাবু সরে গিয়ে দ্বার-প্রান্তে দাঁড়ালেন সহধর্মিণীর ডাকে।ফিরে এসে তিনি ডাক্তার দাশগুপ্তকে জানালেন যে তারা যখন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন তখন ঠাকুরমহাশয় তাঁহার শয্যার সামনে তাদের তিনজনের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের জন্য আপন হাতে পরিপাটি শয্যা রচনা করে রেখেছেন।তারা কি সেই শয্যার মর্য্যাদা না দিয়ে শুধু কান্নাকাটি করেই ঠাকুরমহাশয়কে আরও দুঃখ দিতে চান! আবার সজল হয়ে উঠল তিনজনের চোখ।
ঐ শয্যার উপর লুটিয়ে পড়লেন তিনজনেই।তারা কাঁদছেন,বিছানায় মুখ ঘষছেন আর বলছেন, এত করুণা তোমার-আমরা যে সম্পূর্ণ অযোগ্য-আমরা যে সম্পূর্ণ অপাত্র।দ্বারপ্রান্ত থেকে মতিবাবুর সহধর্মিণী বিপুল আনন্দে দেখছেন ঠাকুরমহাশয় ধীরে,অতি ধীরে,আপন শয্যা ত্যাগ করে তাঁর আশীর্ব্বাদ-ভরা হাত দু'টি তিনজনের মাথার উপরই রাখছেন বারবার।
জয় রাম জয় গোবিন্দ

ফেইসবুক থেকে সংগ্রহীত 
ঠাকুরমহাশয় সস্নেহে বললেন, "ওতে কোন দোষ হয় না।  ঠাকুরমহাশয় সস্নেহে বললেন, "ওতে কোন দোষ হয় না। Reviewed by SRISRI RAMTHAKUR KOTHA O BANI YOUTUBE CHANNEL on 18:59 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.