ঠাকুরমহাশয় ব্রহ্মচারীর কথা শুনলেন। ব্রহ্মচারীকে পুনর্দীক্ষিত হবার বাসনা পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করলেন,কারণ ব্রহ্মচারীর দীক্ষায় কোন দোষ ছিল না। ঠাকুরমহাশয় ব্রহ্মচারীকে বললেন, ''যেমন আছেন, তেমনে থাকবেন।যাহা পাইছেন তাহা লয়ে থাকবেন। কালে দেখা হইব।"
ব্রহ্মচারীর বাসনা পূর্ণ হলো না, কারণ ঠাকুরমহাশয় তাকে নাম দিতে অসম্মত হয়েছিলেন। তবু তিনি অত্যন্ত আনন্দবোধ করছিলেন এই স্বল্পকালীন ঠাকুরমহাশয়ের সান্নিধ্যলাভে।ঠাকুরমহাশয়ের কথার ওপর বিশ্বাস রেখেই তিনি দেহত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ব্রহ্মচারীই ছিলেন। পুনরায় দীক্ষা নেওয়ার আর কোন প্রচেষ্টা তিনি করেননি। মন্ত্রশক্তির ওপরই নির্ভর করে তিনি নির্ভয় হয়েছিলেন। ঠাকুরমহাশয় আশ্বাস দিয়ে তাকে বলেছিলেন যে কালে দেখা হবে। এ আশ্বাসে বিশ্বাস তিনি কেমন করে রাখবেন? কখন ঠাকুরমহাশয়ের সময় হবে আর ব্রহ্মচারীই বা কোথায় থাকবেন তা ঠাকুরমহাশয় জানবেন কী করে? সেজন্য মনে হয় তাহার পুনরায় সাক্ষাৎলাভ সুদূর পরাহত।
এই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা।কার্য্য সমাপ্তির পর ব্রহ্মচারী পদ্মানদীর ওপর দিয়ে জাহাজে ফিরছিলেন।তখন বর্ষাকাল।চতুর্দিকের আকাশ সহসা ঘন মেঘে ঢেকে গেল।প্রমত্তা পদ্মানদী এবার উন্মাদিনী ভয়ঙ্করী রুপ ধারণ করল।প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হল।ঝঞ্চার মধ্যে মাঝে মাঝে বজ্রপাতের শব্দও শোনা যাচ্ছিল।পদ্মার উদ্বেলিত জলরাশি ক্ষণেক্ষণে জাহাজের নীচের ডেকের ওপর আছড়ে পড়ছিল,প্রমাদ গুণলেন যাত্রীরা সকলেই। ভীত কাতর স্বরে সকলের কন্ঠে 'মধুসূদন' 'মধুসূদন' শোনা যাচ্ছিল।যে কোন সময়ে এত যাত্রী নিয়ে জাহাজটি পদ্মার করাল গ্রাসে চলে যেতে পারে।জাহাজের ওপর তলা থেকে যাত্রীদের নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে। কারণ জাহাজের দ্বিতলে থাকা আরও বিপজ্জনক।
জাহাজের নাবিক যে ক'টা লাইফ-বেল্ট ছিল সে ক'টি যাত্রীদের মধ্যে বিলি করে দিলেন। ব্রহ্মচারীও একটি পেলেন কিন্তু অসংখ্য যাত্রীর তুলনায় লাইফ-বেল্টের সংখ্যা ছিল অতিসামান্য। তাই লাইফ-বেল্ট যারা পেলেন না তাদের ভীতিও বৃদ্ধি পেল।
বাহিরে প্রচন্ড ঝঞ্ঝা ও বৃষ্টি। মোচার খোলার মত জাহাজটি নদী বক্ষে দুলছে।ডেকে শত শত নারী ও শিশুদের ক্রন্দন ও আর্তনাদ ঝড় বৃষ্টির শব্দকেও ছাপিয়ে উঠেছে। ব্রহ্মচারী তার সামনে একটি অল্পবয়স্ক বালকের হাতে তার পাওয়া লাইফ-বেল্টটি তুলে দিলেন।বিপদে এই বালকটি যদি ভগবানের কৃপায় রক্ষা পায়,তার জীবন রক্ষার চেয়ে সেইটি হবে অনেক মহৎ কাজ।হঠাৎ ব্রহ্মচারী দেখলেন যে দ্বিতলের সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ঠাকুরমহাশয় হাত নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে কোন ভয় নেই। ভীড় ঠেলে ব্রহ্মচারী সিঁড়ির দিকে ছুটলেন পাগলের মত। ঠাকুরমহাশয়ের পাদস্পর্শ করার জন্য।অনেক হাত এক সঙ্গে তাকে আকঁড়ে ধরল তার গতিরোধ করার জন্য।বহুকন্ঠ একসঙ্গে তাকে বলে উঠল,বিপদ দেখে জাহাজের সব যাত্রী নীচে নেমে এসেছে আর তিনি কি না উপরে উঠতে যাচ্ছেন? ঠাকুরমহাশয়ের আশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ব্রহ্মচারী তার আশপাশের সকলকে বললেন, আপনারা কোন ভয় পাবেন না। এই ঝড়ে আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না।
ধীরে ধীরে ঝঞ্ঝার গতিবেগ মন্দীভূত হয়ে এল,লঘু হয়ে এল আকাশের মেঘরাশি।প্রমত্তা পদ্মা ক্রমশঃ শান্ত হয়ে এল,যাত্রীদের ভয় গেল কেটে, সকলের মুখ চোখের অবস্থা আবার স্বাভাবিক হল।এ যেন সত্যই এক নব জন্মলাভ।
ব্রহ্মচারী তখন হিমগিরি কোলে তপস্যায় রত ছিলেন। একদিন অপরাহ্নে তিনি অপর একজন তাপসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যাচ্ছিলেন। কিছুদূর যাবার পর এক প্রচন্ড তুষার ঝঞ্ঝার মধ্যে পড়লেন। তখন না পারেন এগোতে, না পারেন পিছোতে। দেহের সমস্ত বস্ত্র পূর্ণ সিক্ত।ব্রহ্মচারী ঠক ঠক করে কাঁপছেন।আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। এখনি পড়ে যাবেন,পড়ে গেলে কোন অতলে যে তিনি তলিয়ে যাবেন তার তো ঠিক নেই।ব্রহ্মচারী শিহরিয়া উঠলেন। এই মহা সঙ্কটের সময় সহসা তিনি অনুভব করলেন কে একজন যেন প্রসারিত করে তার অঙ্গের বস্ত্র খুলে নিচ্ছেন।নিমীলিত চোখে চেয়ে তিনি দেখলেন যে ঠাকুরমহাশয় তাঁর অঙ্গের কাপড় দিয়ে তাকে একটা মোটা গাছের সঙ্গে বাঁধছেন।ব্রহ্মচারীর বাকশক্তি তখন লুপ্ত প্রায়। অর্দ্ধ-নিমীলিত নয়নে তিনি দেখলেন গাছের সঙ্গে তাকে দৃঢ় করে বাঁধার পর ঠাকুরমহাশয় সেই তুষার ঝঞ্ঝা ভেদ করে নীচের চলার পথ দিয়ে অতি দ্রুতচরণে চলে যাচ্ছেন।
ব্রহ্মচারী এখন অতিবৃদ্ধ।ঠাকুরমহাশয় তাকে যে বলেছিলেন, কালে দেখা হবে, সেটা মিথ্যা শ্লোক বাক্য নয়।সঙ্কটকালে দু'বার সেটা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য তার হয়েছে। তাই গভীরআশা তার আছে,মৃত্যুর মহামুহুর্তে অতিকষ্টের কালে নিশ্চিত আবার ঠাকুরমহাশয়ের দর্শন লাভ হবে।
সেই আশার প্রদীপ জ্বেলেই ব্রহ্মচারী সমাহিত থাকেন।সেই আশাকে সম্মুখে রেখেই তিনি সর্বক্ষণ শান্ত।
জয় রাম জয় গোবিন্দ
No comments: